******************************
যতীন্দ্র প্রসাদের দশীবিদেশী ছন্দে কবিতা ও ছড়া।
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী।
নমস্কার।
মধ্যগগনে রবির করোজ্জলের তাপের আঁচে শৈশব কৈশোরের দিন কেটেছে কবি যতীন্দ্রপ্রসাদের।
যতীন্দ্রপ্রসাদকে জানেন না, এরকম বাংলা ভাষার পাঠকের সংখ্যা খুবই কম, বিশেষ করে কবিতার রস যাঁরা নিতে অভ্যস্ত।এই কবি থাকতেন সুদূর মৈমনসিংহের গৌরীপুরে। সেই জেলা ১৯৪৭-এ দেশ বিভাজনের ফলে অন্যান্য জেলাগুলোর সঙ্গেপূর্ব পাকিস্তানে র'য়ে গেছে এবং ১৯৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের পর নবনির্মিত বাংলাদেশের মধ্যে আজও স্বনামে র'য়ে গেছে।
আমরা চিরকাল স্মরণ করি -
"আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি ......"
কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ পশ্চিম এশিয়ার ' বুলবুল গুলজার ' ছন্দে ,'চাষীর প্রতি' কবিতায় লিখেছেন -
""তোর মাটি তোর ভূঁই
ক্ষেত ভরা ধান তোর
তুই তবু জোচ্চোর
দিনরাত ভ্রান্তি । ........"
ভাবা যায় বংশানুক্রমে জমিদারের ভাই আর একান্ত বিশ্বস্ততার জন্য জমিদারীর প্রধান নায়েব এমন কবিতা লিখতেপেরেছেন ! তা শুধু লেখার জন্য বিলাসিতা নয়। আন্তরিক কবি অন্তর দিয়েই গ্রামের গরীব চাষীভাইদের সঙ্গেও থাকতেভালোবাসতেন।
পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দেশ জাপান। সেখানকার ' তানকা ' ছন্দে কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ লিখেছেন ' বাজাও বিউগল ' কবিতা :-
"খণ্ড যা, তা
যুক্ত করা চাই।
কাজের শেষ
তার তো আগে নাই;
এগিয়ে চলো যাই।..........."
পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ পূর্ব এশিয়ার চীন প্রজাতন্ত্র। তাঁদের প্রাচীন ছন্দে 'সুখের পায়রা' কবিতায় লিখেছেন :-
"তার তো নাই সে রূপ !
গাল, দুচোখ যে কূপ !
মুখ তো নয়রে চাঁদ।
কয় সে, হায় কি ছাঁদ।
এরকম দেশ বিদেশের নানান ছন্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করে নিজের মৌলিক কবিতা রচনা করেছেন।
আমরা প্রায় সবাই জানি, ভাষা তত্ত্বের নিরিখে হিন্দ-ইরাণী আর্যভাষা থেকেই সংস্কৃত ও ফারসী ভাষার উদ্ভব। সংস্কৃতথেকেই এসেছে হিন্দী ও বাংলা ভাষা। তাই কবির কাছে বাংলা ভাষার মূল সংস্কৃত ও ফারসী ভাষার প্রতি কিছু পেছুটানমাঝে মাঝেই লক্ষ্য করা যায়। এটা হৃদয়বান ভালবাসার কবির পক্ষেই স্বাভাবিক।
তাই, কবি পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি ছন্দ ব্যবহার করে, বিশেষ করে 'মোতাদারেক' , 'হজ্ য ', 'মোতাকারিব', ' মদীদ ', 'রমল'', ' রজ্ য ', 'তরীল ' ও ' বুলবুল গুলজার ' ছন্দের ব্যবহার করে নিজের কবিতা রচনা করেছেন।
কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য তাঁর ' নতুন বৌ ' কবিতায় 'মোতাদারেক' ছন্দ ব্যবহার করেছেন যেমন :-
" সিন্দুর সুন্দর
নির্মল অন্তর
আঁখ-বাক্-সংযম
ভরপুর সম্ভ্রম........"
'হজ্ য ' ছন্দে -
" সেমিজ শাড়ী, চলন ভারী
অলঙ্কারে অহঙ্কারী
নিটোল শোভা, ভুবন-লোভা
বাচাল হিয়া, বদন বোবা........."
সৌন্দর্যের প্রতি টান না থাকলে কেউ কি কবি হতে পারেন ? কবির স্বাভাবিক টান ছিল সৌন্দর্যের প্রতি।
'মদীদ' ছন্দে কবি লিখেছেন 'ধর্মের ষাঁড়' কবিতাটি -
" সন্ধ্যা-আহ্নিক বাইরে খুব !
মিথ্যা জপ তপ, নিত্য ডুব।
বস্ত্র গৈরিক, লম্বা কেশ ;
কন্ঠে শঙ্খের মাল্য বেশ।....."
হরেক রকমের ছন্দের ব্যবহার করার সঙ্গে তিনি ধাতব যন্ত্র হয়ে যাননি। কবি সমাজের ভেকধারী ধর্মের ধ্বজা ওড়ানোলোভীদের প্রতিও হয়েছেন খড়্গহস্ত।
কবি ' মোতাকারিব ' ছন্দের প্রয়োগের সঙ্গে শুধুমাত্র বুকনি আওরানো রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি শ্লেষ বর্ষণ করতে দ্বিধাকরেন নি। এই ছন্দে তিনি রচনা করেছেন 'নেতা ' কবিতা -
" টাউন হল মফঃস্বল
অনর্গল মুখের বল
চালাক ধীর, পায়েস ক্ষীর
শোভন শির, লোকের ভীড়। ..."
' তরীল ' ছন্দ ব্যবহার করে তিনি, হ্যাঁ কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ' শকুনি ' কবিতা যেমন -
" ঠোঁটেই জোর, লায়েক বিধান ;
দিবস রাত ভাগাড় সন্ধান।
লাগায় তাক যখন দ্যায় 'স্পীচ' ;
নীচের সাথ, হৃদয় রয় নীচ।
যেথায় থাক্, শকুন চায় সব।
বাড়ায় ছাই দেশের গৌরব।......"
এসব তো আজও চলছে, মিডিয়াতে আমরা অহঃরহ দেখতে পাই, শুনতে পাই। ছন্দ ব্যবহার করতে গিয়ে কবি সমাজেরছবি তুলে ধরতে চেয়েছেন।
' রমল ' ছন্দে কবি সমাজের সাধারণত দৃশ্য অবহেলিত নিঃশেষিত ' 'বৃদ্ধা ' দের নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেন -
" কোষ্ঠা-কুন্তল, দৃষ্টি ঘোর-ঘোর
চামড়া ঢিল ঢিল, দন্ত নড়বোড়
ভাবনা হরদম মৃত্যু শঙ্কার
শক্তি খুব কম, শুষ্ক সংসার।...."
কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য এরকম কবিতা রচনা করেছেন দেশীবিদেশী ভাষার ছন্দে। তাঁর কোন কবিতাই নিছকবিনোদনের জন্য নয়। সমাজ সংসার থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন ছিলেন না।
এজন্য কবি আজও প্রণম্য তাই তাঁকে জানাই প্রণাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন